কুয়েটের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেনকে মানসিক নির্যাতন চালিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তার স্ত্রী ও শিক্ষক সমিতির৷ এই ঘটনায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ নয়জনকে বহিস্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷
মঙ্গলবার বিকেলে খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন তার বাসায় মত্যুবরণ করেন৷ তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বলে জানা গেছে৷ তবে তার মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি৷ ক্যাম্পাসে তিনি দুই দফা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মানসিক নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ এই ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি৷ বিচারের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷
ড. সেলিম কুয়েটের লালন শাহ আবাসিক হলের প্রভোস্টের দায়িত্বে ছিলেন৷ ক্যাম্পাসে নানা পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, কুয়েটের বিভিন্ন হলে প্রতিমাসেই ছাত্রদের ভিতর থেকে দুইজনকে ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচিত করা হয়৷ ডিসেম্বর মাসের জন্য লালন শাহ আবাসিক হলের ডাইনিং ম্যানেজার হওয়ার জন্য ছয়-সাতজন ছাত্র আবেদন করেন৷ কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান গ্রুপের দাবি ছিলো তাদের গ্রুপের ছাত্রদের মধ্য থেকে ম্যানেজার করতে হবে৷ তার প্রতিপক্ষ সভাপতির গ্রুপ৷ ২৯ নভেম্বর রাতে ডাইনিংয়ে এ নিয়ে বৈঠকও হয়৷ তাতে কোনো সমাধান আসেনি৷ এরপর থেকেই সেজান ও তার অনুসারীরা হলের প্রভোস্ট ড. মো. সেলিম হোসেনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখেন৷
মঙ্গলবার দুপুর ১২ টার দিকে সাদমানের অনুসারীরা ক্যাম্পাসের রাস্তায় ড. সেলিমের গতিরোধ করে তার সাথে তর্কে জড়ান৷ এরপর তারা ড. সেলিমের পিছু নিয়ে তড়িৎকৌশল ভবনে ওই শিক্ষকের কক্ষে যান৷ সেখানে তারা আরো আধা ঘণ্টা অবস্থান করেন৷
কুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নিবিড় রেজা বলেন, ‘‘ঘটনাস্থলে সেজানের অনুসারীরা সংখ্যায় ৪০-৪২ জন ছিল৷ বাইরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তাদের দেখা গেছে৷ কিন্তু কক্ষের ভিতরে তো আর সিসি ক্যামেরা ছিলোনা৷ তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন স্যারকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে৷’’
ড. সেলিমের স্ত্রী সাবিনা খাতুন অভিযোগ করেন, ‘‘ঘটনার দুই-তিন আগে রাতে আমার স্বামীকে ফোন করে কেউ একজন উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন৷ তাকে বলছিলো, ক্যান্টিনের ম্যানেজার আমাদেরকেই করতে হবে৷ তখন আমার স্বামীকে বিচলিত দেখাচ্ছিল৷’’
তিনি জানান, ঘটনার দিন একটার সময় বাসায় আসার কথা থাকলেও তিনি বাসায় ফেরেন দেড়টার পর৷ সাধারণত তিনি বাসায় ফিরে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করেন৷ তারপর অন্য কাজ করেন৷ কিন্তু ওই দিন তিনি বাচ্চাকে আদর না করে ওয়াশরুমে চলে যান৷ ‘‘তার চুলগুলো ছিলো এলোমেলো৷ চোখ দুটো ছিল লাল৷ আমাকে বলল, ‘আমার আসতে দেরি হল স্টুডেন্টরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল৷’ … এরপর তিনি ওয়াশরুমে চলে যান৷ বেশ কিছুক্ষণ পর বের না হওয়ায় আমাদের সন্দেহ হয়৷ কোনো সাড়া দিচ্ছিলেন না৷ পরে আমরা ওয়াশরুমের ভিতরে তাকে নিথর বসে থাকতে দেখি৷ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন,’’ বলেন সাবিনা খাতুন৷
তিনি জানান, তার স্বামীর মরদেহের গলায় দাগ দেখতে পেয়েছেন৷ বলেন, ‘‘আমরা জানি না যে এগুলো হয়েছে, নাহলে কিন্তু সাথে সাথেই আমরা দেখি৷ সেতো আমার সঙ্গে ঘরে এসে কথা বলোর সুযোগ পায়নি, তার সম্ভবত খারাপ লেগেছিল, এজন্য ওয়াশরুমে ঠুকে পড়ে৷’’
মামলার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আমি প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি৷ দেখি তারা কী করেন৷ আমি তো অবশ্যই মামলা করব৷ আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে৷ তার কোনো ধরনের কোনো রোগ ছিল না৷ আমি আমরা স্বামীর হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই৷’’
কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘‘স্যারের মৃত্যুর পর আমরা শিক্ষক সমিতি বৈঠক করে প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র, শিক্ষকদের বক্তব্য শুনেছি৷ ভিডিও ফুটেজ ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছি৷ তাতে আমরা সবাই একমত হয়েছি যে ড. সেলিম স্যারের মুত্যু কোনোভাবেই স্বাভাবিক মৃত্যু নয়৷ মানসিক অত্যাচারের মাধ্যমে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে৷ আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া শুরুর অনুরোধ জানিয়েছি৷’’
বিশ্ববিদ্যালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ আর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ নয়জনকে শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করেছে সিন্ডিকেট৷ সিন্ডিকেট জানিয়েছে তারা প্রাথমিকভাবে মানসিক নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে৷ কিন্তু এখনো কোনো মামলা হয়নি৷ প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘‘যোকোনো মামলায়ই দেরি হলে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷”
এ নিয়ে কুয়েটের ভিসিকে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি৷ তবে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সাদমান নাহিয়ান সেজান দাবি করেন, তাদের সাথে ড. সেলিমের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা অল্প সময় তার সঙ্গে রাস্তায় ও তার রুমে কথা বলেছি৷ তিনি মানসিক চাপে পড়েন এমন কোনো কথা হয়নি৷ তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন৷ ডেথ রিপোর্টে তা বলা আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে আমাদের বহিস্কার করেছে৷ আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই৷’’